একযুগে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। প্রশ্নফাঁসে পিএসসির দুই উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক ও দুইজন অফিস সহায়কসহ ১৭ জনকে গ্রেফতারের ঘটনায় করা মামলা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে। মূলহোতাদের চিহ্নিত করার জন্য নানা তথ্য সংগ্রহ করছে সিআইডি।
গ্রেফতারদের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন, জব্দ মোবাইল ফোনের তথ্য ও জবানবন্দির ভিত্তিতে ফেঁসে যেতে পারেন পিএসসির বেশকিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে চাকরি পাওয়া কর্মকর্তারা।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে সরকারের শীর্ষ মহলের সবুজ সংকেত রয়েছে বলেও জানা গেছে। এরই মধ্যে গ্রেফতারে ছয়জনের জবানবন্দিতে নাম আসা পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারী, চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে মাঠে কাজ করছে সিআইডির গোয়েন্দা দল।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসসির পরীক্ষা-শাখা (নন-ক্যাডার), তথ্য-প্রযুক্তি শাখা, ইউনিট-১২ ও পিএসসি সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম সামনে এসেছে। পিএসসির ডেসপাস রাইটার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, পিএসসির অন্তত ছয় কর্মকর্তাকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর বাইরে আরও ৯ জনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। যারা পরীক্ষার বুথ পরিচালনা ও টাকা সংগ্রহ করতেন। এছাড়া মামলায় পলাতক কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের যেকোনো সময় গ্রেফতার করা হবে।
পাওয়া যাচ্ছে আরও যে পাঁচ কর্মকর্তার নাম
রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে। কেবল এই ছয়জনই নন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে পিএসসির আরও পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম সামনে এসেছে, যারা বিভিন্ন সময় ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাও আছেন। আবার অফিস সহায়ক ও গাড়িচালকও আছেন।
এই পাঁচজন হলেন, পিএসসির পরিচালক এনামুল বশির, সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান।
পিএসসি সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে এই পাঁচজনকেই একসময় চাকরিচ্যুত করেছিল পিএসসি। পরে এনামুল বশির ও আবদুর রউফ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান। অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান চাকরিচ্যুত হয়েছেন দুই বছর আগে। সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায় গত বছর অবসরে গেছেন।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, বেশকিছু নতুন তথ্য পেয়েছি। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। রিমান্ডে আসামিদের পেলে সবকিছু বিষয় জানা যাবে।
যে কারণে ৬ জনকে রিমান্ডে চায় পুলিশ
যাদের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে তারা হলেন, পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, পিএসসির সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, উপপরিচালক আবু জাফর, প্রতিরক্ষা ও অর্থ বিভাগ এসিসিডিএফের (বিওএফ) অডিটর প্রিয়নাথ রায়, মিরপুরের পোশাক কারখানার ব্যবসায়ী নোমান সিদ্দিকী ও ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম।
রিমান্ডে নিয়ে যা জানতে চাইবে সিআইডি
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বাংলাদেশ রেলওয়ে), পদের নাম, সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার মূল প্রশ্ন তারা কীভাবে সংগ্রহ করতেন এবং তাদের কে সরবরাহ করতেন। প্রশ্নফাঁসের এই চক্রটির সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত। কীভাবে তারা প্রশ্নফাঁস করতেন। কারা কারা কীভাবে তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন। কীভাবে নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করতেন। কতজন নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করা হয়েছে। প্রশ্নফাঁসের এই চক্রটির দ্বারা প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মোট কত পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে। লেনদেন করা অর্থের সুবিধাভোগীদের শনাক্ত করা। মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধারসহ এসব বিষয়ে রিমান্ডে ওই ছয় আসামির কাছে জানতে চাইবে সিআইডি।
মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করবে সিআইডি
বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও রয়েছেন। বিএফআইউ সূত্র জানায়, ব্যাংক হিসাব জব্দ সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদকে পিএসসির চিঠি
বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯ জুলাই সাময়িক বরখাস্ত করে পিএসসি। ১০ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে রয়েছেন পিএসসির দুই উপ-পরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডেসপাচ রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলাম।
কারাগারে ১১ আসামি
কারাগারে যাওয়া অন্য আসামিরা হলেন, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তাপ্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল। তাদের মধ্যে সোহেল স্বীকারোক্তি দিতে না চাইলে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়।
যে ছয়জনের দায় স্বীকার
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় করা মামলায় পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যরা হলেন- পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক (ডেসপাস) সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার।
পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিলসহ ১৪ জন এখনো পলাতক
মামলার পলাতক আসামিরা হলেন, পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, মো. শরীফুল ইসলাম, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, একেএম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
যা বলছে পিএসসি
পিএসসি সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের ধরতে নিজেদের গঠিত তদন্ত কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। পিএসসির প্রশ্ন প্রণয়নকারীসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। পিএসসির তদন্ত কমিটির প্রধান পিএসসির যুগ্ম সচিব ড. আব্দুল আলীম বলেন, তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। যেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত প্রত্যেকের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলমান। আসামিদের দেওয়া তথ্য, ডিজিটাল প্রমাণ ও আলামত যাচাই-বাছাই করে আমরা অপরাধীদের শনাক্ত করছি।
তিনি বলেন, গ্রেফতারের পর দায় স্বীকার করে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, বাকিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় যাদের নাম আসবে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে।